বাল্য বিবাহ এবং কিশোরী গর্ভধারণের পুনরাবৃত্তি: একটি কোভিড পরবর্তী সামাজিক দুর্যোগ
অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন সত্ত্বেও মেয়েদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থান বেশ উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে কিশোরী গর্ভধারণের হার সবচেয়ে বেশি (২৭.৭%)। একই সময়ে ভারত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের হার যথাক্রমে ৬.৮%, ৮.১% এবং ১২.১%।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায় যে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ২৮টি জেলায় ২,৩০১ জন মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। সেই হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ২৮৮ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিকালীন গর্ভধারণের উচ্চহারের কারণগুলি বেশ পরিচিত, যার মধ্যে রয়েছে বাল্যবিবাহ, অপর্যাপ্ত গর্ভনিরোধক পণ্য, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধতা এবং প্রচলিত লিঙ্গ রক্ষণশীলতা। বিশেষ করে, বাল্যবিবাহের কারণে এই সমস্যাটিকে আরও প্রকটাকার ধারণ করছে।
খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় চালানো জরিপ অনুসারে বাল্যবিবাহ মোকাবেলায় প্রচলিত বাধাগুলো সম্পর্কে বিশদ জানা যায়। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বন্ধ হওয়া ৮৮টি বাল্যবিবাহের মধ্যে ৭৪% পরে আবার গোপনে সংঘটিত হয়েছিল। কিছু বাল্যবধূ যৌতুকের দাবির কারণে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। বিশেষত ৭ম থেকে ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে বলে জানা যায়।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে এই তথ্য মহামারীর আগে পরিচালিত একটি সমীক্ষার উপর ভিত্তি করে। গত কয়েক বছরে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি এখন আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন এলাকার তথ্যে দেখা যায় যে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে অন্তত ১১,০০০ স্কুল শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে। একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২৮টি জেলায় ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ২,৩০১ জন মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে।
বাল্যবিবাহ কৈশোরকালীন গর্ভধারণ বৃদ্ধির মূল কারণ, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে, বাল্যবধূদের তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। গর্ভবতী হওয়ার চাপ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগের অভাব সাধারণত তাদের শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে। অল্পবয়সী মেয়েরা গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের সময় যে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির মুখোমুখি হতে পারে, যেমন একলাম্পসিয়া, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ, সংক্রমণ, প্রিটার্ম ডেলিভারি, কম জন্ম ওজন, এবং নবজাতকের মৃত্যু, এর দায় উভয় পরিবার এবং কর্তৃপক্ষেরই নিতে হবে।
এই সমস্যাটি সমাধানের জন্য প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, বাধাপ্রাপ্ত বিয়ে পুনরায় গোপনে সংঘটিত হওয়াকে প্রতিরোধ করতে হবে, এবং সর্বোপরি সরকারকে অবশ্যই অপ্রাপ্তবয়স্ক বিবাহের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সরকার একা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে না। এই সমস্যাকে চিরতরে নির্মূল করতে এবং শিশুদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সমগ্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
উৎসঃ
১. প্রথম আলো, ৬ অক্টোবর ২০২২
২. ডেইলি স্টার, ১০ নভেম্বর ২০২২